দেশে রাজনৈতিক সচেতনতা প্রয়োজন। বিরাজনীতিকরণের প্রবণতা থেকে সরে এসে তরুণদের রাজনীতিমুখী করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ চালু করতে হবে। তরুণদের জীবনের বিনিময়ে আসা পরিবর্তনে দেশ গঠনে যেন তাঁদের ভূমিকা থাকে, সে ব্যবস্থার আইনি কাঠামো প্রয়োজন। তরুণ ও নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং নেতৃত্ব গড়ে তুলতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ওপর জোর দিতে হবে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ: তরুণদের ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা উঠে আসে। ইয়ুথ ফর পলিসি এবং আইআইডির উদ্যোগে আয়োজিত এ গোলটেবিলে তরুণেরাই নিজেদের ভাবনা তুলে ধরেন। এ আয়োজনের প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মামুন আবদুল্লাহি তাঁদের অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গে বলেন, একটা গণপরিষদ করা, যার ভিত্তিতে সংবিধানকে নতুন করে করা, শাসনতান্ত্রিক কাঠামো কেমন হবে এবং নির্বাচনকালীন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা ঠিক করা। এ ছাড়া তিনি বলেন, রাজনৈতিক লিটারেসি (সচেতনতা) প্রয়োজন। এর জন্য ক্যাম্পাসগুলোতে কাজ শুরু হয়েছে। এখান থেকেই তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।
কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছাত্র সংসদের ব্যবস্থা যদি টানা পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত করা যায়, তাহলে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়বে এবং নেতৃত্বের চেহারা পাল্টে যাবে বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা। তিনি আরও বলেন, ‘ইউজিসি বাদ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাধীন মত দিতে হবে।’
সংসদে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব রাখার জন্য উমামা সংরক্ষিত আসন রাখার কথা উল্লেখ করে বলেন, নির্বাচন করার বয়স ২৫ বছর হওয়া না হওয়ায় কিছু আসে–যায় না। কারণ, এখানে সামাজিক কাঠামো, পেশিশক্তি ও টাকার কারণে তরুণদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করে আসা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, নারীকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় না আনা গেলে সংরক্ষিত আসন রেখে লাভ নেই। নারীদের স্থানীয় পর্যায় থেকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত বলেন, স্কুল পর্যায়ে আগে স্কাউটিংসহ সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ছিল। এসব বজায় থাকলে তখন নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়াগুলো এখন দেখা যায় না। নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য এগুলোর কোনো বিকল্প নেই।
সরকারকে এখন অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নাজিফা আরও বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কেন মুক্তি পাচ্ছে, এ বিষয়গুলোর কারণ গণমাধ্যমকে খুঁজে বের করতে হবে। মানুষ এখন নিরাপদ বোধ করতে চায়।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আশরাফ উদ্দিন মাহদি বলেন, এ দেশে জাতীয় ঐক্য ছিল বলেই এই অভ্যুত্থান হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় হামলা হচ্ছে। যে গোষ্ঠী হামলা করছে, তারা সংখ্যায় কম। শুধু ভাঙতে বা প্রতিবাদ করতে জানে—এমন তারুণ্যের হাতে দেশ গড়তে দেওয়া যাবে না। তাহলে ’২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের লক্ষ্য সফল হবে না।
এই কমিটির আরেক সদস্য অর্পিতা শ্যামা দেব বলেন, তরুণদের আগে রাজনীতিতে আসার সুযোগ তৈরি করতে হবে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলেই দেশের উন্নয়নে তারা ভূমিকা রাখতে পারবে।
আইআইডির প্রধান নির্বাহী ও ইয়ুথ ফর পলিসির প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ আহমেদ বলেন, তরুণদের হাত ধরেই পরির্বতন আসে কিন্তু পরে দেখা যায়, এখানে প্রবীণেরা এসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেন। জননীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণের স্থায়ী বন্দোবস্ত করতে আইনি কাঠামো করতে হবে। নয়তো বারবার তরুণদের প্রাণ দিতে হবে। এবারে অভ্যুত্থানের সুযোগকে সম্ভাবনা হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে কাজে লাগাতে হবে।
বিভিন্ন শিল্পচর্চা প্রতিষ্ঠান ও মাজারে হামলা হচ্ছে জানিয়ে ঢাকার প্লেপেন স্কুলের সংগীতশিক্ষক জয়ীতা তালুকদার স্বাধীনভাবে সবার জন্য সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা নিশ্চিত করার কথা বলেন।
আইআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক ও ইয়ুথ ফর পলিসির ফোকাল সুলতানা মেহজাবীন বলেন, আগে নতুন কুঁড়ি, শাপলা কুঁড়ির মতো প্রতিযোগিতা ছিল। স্কুল থেকে সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য উৎসাহ দেওয়া হতো, যা এখন কমে গেছে। এসব জায়গা থেকেও নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়েও যেন তরুণেরা যুক্ত হতে পারেন, সে কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ইয়ুথ ফর পলিসির নিলয় সাহা বলেন, জাতীয় যুবনীতিতেই তরুণদের রাষ্ট্রক্ষমতার প্রক্রিয়া যুক্ত করার বিষয় রয়েছে। সেই নীতি বাস্তবায়ন করা গেলে সমাধান সম্ভব।
সংস্কৃতিচর্চা প্রসঙ্গে এই তরুণ বলেন, ‘এত দিন যে ধারার সাংস্কৃতিক চর্চা হয়ে এসেছে, ৫ আগস্টের পর এদের মধ্যে একট প্রচ্ছন্ন ভীতি তৈরি হয়েছে যে তাদের সংস্কৃতির জায়গা দখল হয়ে যাবে কি না। আমরা চাই, সব পক্ষের সবার সংস্কৃতির চর্চা হোক।’
আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তনে তরুণদের ভূমিকার কথাও উঠে আসে। ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের জাতীয় সহসমন্বয়ক আরুবা ফারুক জলবায়ু নীতিতে তরুণদের যুক্ত করার আহ্বান জানান।
এ ছাড়া সাংস্কৃতিক কার্যক্রমসহ যেসব কার্যক্রমকে সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেগুলোকে মূল কারিকুলামে যুক্ত করার প্রসঙ্গও আলোচনায় আসে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তরুণেরাও নিজেদের অধিকার ও ভূমিকার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
গোলটেবিলে আরও অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিশাত আনজুম, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মাসুদ, স্কলাস্টিকা স্কুলের শিক্ষার্থী গার্গী তনুশ্রী পাল, ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী শবনম সুলতানা ও আথিনা চাকমা, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আসহাবিল ইয়ামিন, বন্ধুসভার সদস্য শাহরিয়ার সীমান্ত এবং বান্দরবান কলেজের শিক্ষার্থী রংথইন ম্রো ও ইতি চৌধুরী।